সড়কে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে মোটাদাগে বেপরোয়া গতি, চালকদের খামখেয়ালি ও যাত্রীদের অসতর্কতা, অনাকাঙ্ক্ষিত সর্পিল পথ ও ভয়ঙ্কর বাঁক, হঠাৎ বিটুমিন উঠে ইট-পাথরের বেরিয়ে আসা ইত্যাদিকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এ ধরনের কারণগুলোকে চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর মধ্যে আছে সড়কের উন্নয়নে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প। এসব প্রকল্প একদিকে যেমন সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সড়কের নিরাপত্তায় সরকারের নজর চার লেন সড়কে। কারণ অধিকাংশ সময় পরিবহনগুলোর ওভারটেকিং প্রবণতায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে এক লেন সড়কে পরিবহনগুলোর মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রতিনিয়ত ঝরছে বহু তাজা প্রাণ। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ২১৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেন করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এর দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার।
চার লেন সড়কের ফলে একদিকে দুর্ঘটনা কমছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হচ্ছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নকে সামনে রেখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন সংস্থাগুলো নিরাপদ সড়কের উন্নয়নে সড়ক নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, সেতু , ফ্লাইওভার ও টানেল নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় সরকার আরও ৮৫৯ কিলোমিটার সড়ক চার, ছয় ও আট লেনে রূপ দিতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সারাদেশে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. আব্দুল মালেক বলেন, অদক্ষ চালকের পাশাপাশি সড়কের বেহাল দশার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সরকার দেশের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে বড় ভূমিকা পালন করছে। অনেক সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চার লেন, ওভারপাস, পদ্মা সেতু, টানেল এসব বড় অবকাঠামোও সড়ক নিরাপদ করতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার সারাদেশে চার লেন সড়ক নির্মাণে নজর দিচ্ছে। যেখানে চার লেন আছে সেখানে সেভাবে পরিবহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ নেই।
ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের সুফল মিলছে। এই বিবেচনায় সরকার ৮৫৯ কিলোমিটার সড়ক চার, ছয় ও আট লেনে রূপ দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। কোথাও বাস্তবায়ন মাঝ পর্যায়ে, আবার কোথাও চার লেন নির্মাণের জন্য চলছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ। ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনে উন্নীত হতে যাচ্ছে ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর জাতীয় মহাসড়ক। উত্তরবঙ্গে শিল্প কারখানার প্রসারসহ পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে চার লেন হচ্ছে এই মড়াসড়ক। প্রকল্পের অগ্রগতি ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক কোথাও চার লেন, আবার কোথাও ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। এরই মধ্যে মন্ত্রিসভায় প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০৯ দশমিক ৩২৮ কিলোমিটার সড়কের এ কাজে ব্যয় হবে মোট ১৭ হাজার ১৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। মহাসড়ক নির্মাণকাজে এক দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের মাল্টিট্রান্স ফিন্যান্সিং সুবিধা (এমএফএফ) অনুমোদন করেছে উন্নয়ন সংস্থা এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
এগিয়ে চলেছে জয়দেবপুর-এলেঙ্গার ৭০ কিলোমিটারকে চার লেন সড়কে উন্নীত করার কাজও। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হবে।
কুমিল্লা নগরীর টমছম ব্রিজ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটার সড়ক ফোর লেনে উন্নীতকরণের কাজও চলছে দ্রুত। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলার মানুষ উপকৃত হবেন। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ অর্ধেক শেষ। যে গতিতে কাজ চলছে সেভাবে চললে ২০২২ সালের আগেই প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে।
৭৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনীর মহিপাল থেকে নোয়াখালীর চৌমুহনী পূর্ব বাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন ৩০ কিলোমিটার চার লেন সড়কের কাজ চলমান। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সিলেট থেকে তামাবিল স্থলবন্দরের সংযোগ সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৬৫ দশমিক ৩০ কিলোমিটার। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে পাথর ও কয়লা আমদানি করা হয় এ সড়ক দিয়ে। চলে ভারী যানবাহন। তবে দীর্ঘদিন থেকে সড়কটির বেহাল দশা। এই সড়কের কাজে প্রস্তাবিত মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৩২৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত ২৩৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার ছয় লেন মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মহাসড়কের দুই পাশে ৩০২.৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলছে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৮৯৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। এরপরই শুরু হবে সড়ক নির্মাণের কাজ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অষ্টম (২০২০-২০২৫) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সাব-সেক্টরের আওতায় ১৫০ কিলোমিটার নতুন সড়ক, এক হাজার ৮০০ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ও ১২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ চলমান।
এছাড়া ৩৭ হাজার ৫০০ মিটার ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, চার হাজার ১০০ মিটার কালভার্ট পুনর্নির্মাণ, ১১ হাজার মিটার ফ্লাইওভার-ওভারপাস, ৩৭৫ কিলোমিটার রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ ও ৩০টি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
সাব-সেক্টরের আওতায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ, কন্সট্রাকশান অব মাল্টি লেন রোড টানেল আন্ডার দ্য রিভার কর্ণফুলী, গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর-এয়ারপোর্ট সড়কে বাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন নির্মিত হচ্ছে।
নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি ও সড়কের ওপরে চাপ কমাতে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) আওতায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ; ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-১) আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর স্টেশন ও নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার মেট্রারেল লাইন নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-৫): নর্দার্ন রুট প্রকল্পের হেমায়েতপুর-আমিনবাজার-গাবতলী-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুনবাজার-ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। চার লেনের পাশাপাশি এসব অবকাঠামোও সড়ক নিরাপদ করতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।